কবিতা
নজরুলের বিদ্রোহি কবিতা
কাজী নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা :
বল বীর -
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি, নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর -
বল মহা বিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’
ভূলোক দ্যুলোক গোলোক ভেদিয়া,
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির বিস্ময় আমি বিশ্ব বিধাত্রীর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর-
আমি চির উন্নত শির।
আমি চিরদুর্দ্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা-প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস,
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর!
আমি দুর্বার,
আমি ভেঙ্গে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
আমি মানি না কো কোন আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!
আমি ধুর্জ্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর!
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাত্রীর!
বল বীর-
চির-উন্নত মম শির!
…
আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি,
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!
আমি উন্মন মন উদাসীর,
আমি বিধবার বুকে ক্রন্দণ শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর!
আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয়-লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের!
আমি অভিমানী চির-ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়,
চিত- চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর!
আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক’রে দেখা অনুখণ,
আমি চপল মেয়ের ভালবাসা, তা’র কাঁকন চুড়ির কন্ কন্।
আমি চির-শিশু, চির-কিশোর
আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর!
আমি উত্তর-বায়ু, মলয়-অনিল, উদাস পূরবী হাওয়া,
আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেনু-বীণে গান গাওয়া।
আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি,
আমি মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি।
আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি এ কি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!
আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!
…
আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী,
মহা- সিন্ধু উতলা ঘুম্-ঘুম্,
ঘুম্ চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝ্ঝুম্
মম বাঁশরীর তানে পাশরি
আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী।
আমি রুষে উঠে’ যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!
আমি শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা,
কভু ধরণীরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল-ধ্বংস-ধন্যা-
আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ঞু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা!
আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমি ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কলা-ফণী!
আমি ছিন্নমন্তা চণ্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!
আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি অজয় অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়!
আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়,
জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি তাথিয়া তাথিয়া মথিয়া ফিরি এ স্বর্গ পাতাল-মর্ত্য!
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!
আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধা!!-
আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার,
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!
আমি হল বলরাম-স্কন্ধে,
আমি উপাড়ি’ ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে,
মহা- বিদ্রোহী রণ-কাল্ত,
আমি সেইদিন সব শান্ত,
যবে উত্পীড়িতের ক্রন্দণ-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত।
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন;
আমি স্রষ্টা-সুদন; শোক-তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন।
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন।
আমি চির-বিদ্রোহী-বীর-
আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির!
কোরবানী
- কাজী নজরুল ইসলাম

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্-বোধন!
দুর্ব্বল ! ভীরু ! চুপ রহো, ওহো খাম্ খা ক্ষুব্ধ মন!
ধ্বনি ওঠে রণি’ দূর বাণীর,–
আজিকার এ খুন কোর্ বানীর!
দুম্বা-শির রুম্-বাসীর
শহীদের শির-সেরা আজি!– রহ্ মান কি রুদ্র নন?
ব্যস্! চুপ খামোশ রোদন!
আজ শোর ওঠে জোর “খুন দে, জান দে, শির দে বত্স” শোন্!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্ধোধন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্ধোধন!
খঞ্জরে মারো গর্দ্দানেই,
পঞ্জরে আজি দরদ্ নেই,
মর্দ্দানীই পর্দ্দা নেই,
ডরতা নেই আজ খুন-খারাবীতে রক্ত-লুব্ধ মন!
খুনে খেল্ বো খুন-মাতন!
দুনো উনমাদনাতে সত্য মুক্তি আন্ তে যুঝবো রণ!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্ধোধন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্ধোধন!
চ’ড়েছে খুন আজ খুনিয়ারার
মুস্ লিমে সারা দুনিয়াটার!
‘জুল্ ফেকার’ খুল্ বে তার
দু’ধারী ধার শেরে-খোদার, রক্তে-পূত-বদন!
খুনে আজকে রুধ্ বো মন!
ওরে শক্তি-হস্তে মুক্তি , শক্তি রক্তে সুপ্ত শোন্!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!
আস্তানা সিধা রাস্তা নয়,
‘আজাদী’ মেলে না পস্তানো’য়!
দস্তা নয় সে সস্তা নয়!
হত্যা নয় কি মৃত্যুও ? তবে রক্ত-লুব্ধ কোন্
কাঁদে– শক্তি-দুস্ত শোন্–
“এয়্ ইবরাহীম আজ কোরবানী কর শ্রেষ্ঠ পুত্র ধন!”
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্ভোধন!
এ তো নহে লোহু তরবারের
ঘাতক জালিম জোর্ বারের!
কোরবানের জোর-জানের
খুন এ যে, এতে গোর্দ্দা ঢের রে, এ ত্যাগে ‘বুদ্ধ’ মন!
এতে মা রাখে পুত্র পণ!
তাই জননী হাজেরা বেটারে পরালো বলির পূত বসন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!
এই দিন-ই ‘মীনা’- ময়দানে’
পুত্র-স্নেহের গর্দ্দানে
ছুরি হেনে’ খুন ক্ষরিয়ে নে’
রেখেছে আব্বা ইব্ রাহীম্ সে আপনা রুদ্র পণ!
ছি ছি! কেঁপো না ক্ষুদ্র মন
আজ জল্লাদ নয়, প্রহ্লাদ-সম মোল্লা খুন-বদন !
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!
দ্যাখ কেঁপেছে ‘আরশ’ আস্ মানে!
মন-খুনী কি রে রাশ মানে?
ত্রাসে-প্রাণে — তবে রাস্তা নে!
প্রলয়-বিষাণ ‘কিয়ামতে’ তবে বাজাবে কোন্ বোধন?
সে কি সৃষ্টি-সংশোধন?
ওরে তাথিয়া তাথিয়া নাচে ভৈরব বাজে ডম্বরু শোন্!–
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!
মুসলিম-রণ-ডঙ্কা সে,
খুন্ দেখে করে শঙ্কা কে?
টঙ্কারে অসি ঝঙ্কারে,
ওরে হুঙ্কারে, ভাঙি গড়া ভীম-কারা, ল’ড়বো রণ-মরণ!
ঢালে বাজ্ বে ঝন্-ঝনন্!
ওরে সত্য মুক্তি স্বাধীনতা দেবে এই সে খুন-মোচন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!
জোর চাই, আর যাচ্ না নয়,
কোরবানী-দিন আজ না ওই?
বাজ্ না কই ? সাজ্ না কই?
কাজ না আজিকে জান্ মাল দিয়ে মুক্তির উদ্ধরণ?
বল্– “যুঝ্ বো জান্ ভি পণ!”
ঐ খুনের খুঁটিতে কল্যাণ-কেতু, লক্ষ্য ঐ তোরণ,
আজ আল্লার নামে জান্ কোরবানে ঈদের পূত বোধন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!
উৎস: অগ্নিবীণা
উমর ফারুক
- কাজী নজরুল ইসলাম
তিমির রাত্রি – ‘এশা’র আযান শুনি দূর মসজিদে।
প্রিয়-হারা কার কান্নার মতো এ-বুকে আসিয়ে বিঁধে!
আমির-উল-মুমেনিন,
তোমার স্মৃতি যে আযানের ধ্বনি জানে না মুয়াজ্জিন।
তকবির শুনি, শয্যা ছাড়িয়া চকিতে উঠিয়া বসি,
বাতায়নে চাই-উঠিয়াছে কি-রে গগনে মরুর শশী?
ও-আযান, ও কি পাপিয়ার ডাক, ও কি চকোরীর গান?
মুয়াজ্জিনের কন্ঠে ও কি ও তোমারি সে আহ্ববান?
আবার লুটায়ে পড়ি।
‘সেদিন গিয়াছে’ – শিয়রের কাছে কহিছে কালের ঘড়ি।
উমর! ফারুক! আখেরি নবীর ওগো দক্ষিণ-বাহু!
আহ্বান নয় – রূপ ধরে এস – গ্রাসে অন্ধতা-রাহু!
ইসলাম-রবি, জ্যোতি তার আজ দিনে দিনে বিমলিন!
সত্যের আলো নিভিয়া-জ্বলিছে জোনাকির আলো ক্ষীণ।
শুধু অঙ্গুলি-হেলনে শাসন করিতে এ জগতের
দিয়াছিলে ফেলি মুহম্মদের চরণে যে-শমশের
ফিরদৌস ছাড়ি নেমে এস তুমি সেই শমশের ধরি
আর একবার লোহিত-সাগরে লালে-লাল হয়ে মরি!
ইসলাম – সে তো পরশ-মানিক তাকে কে পেয়েছে খুঁজি?
পরশে তাহার সোনা হল যারা তাদেরেই মোরা বুঝি।
আজ বুঝি – কেন বলিয়াছিলেন শেষ পয়গম্বর-
‘মোরপরে যদি নবী হত কেউ, হত সে এক উমর।’
* * * * * * * * * *
অর্ধ পৃথিবী করেছ শাসন ধুলার তখতে বসি
খেজুরপাতার প্রাসাদ তোমার বারে বারে গেছে খসি
সাইমুম-ঝড়ে। পড়েছে কুটির, তুমি পড়নি ক’ নুয়ে,
ঊর্ধ্বের যারা – পড়ছে তাহারা, তুমি ছিলে খাড়া ভূঁয়ে।
শত প্রলোভন বিলাস বাসনা ঐশ্বর্যের মদ
করেছে সালাম দূর হতে সব ছুঁইতে পারেনি পদ।
সবারে ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়া তুমি ছিলে সব নিচে,
বুকে করে সবে বেড়া করি পার, আপনি রহিলে পিছে।
হেরি পশ্চাতে চাহি-
তুমি চলিয়াছ রৌদ্রদগ্ধ দূর মরুপথ বাহি
জেরুজালেমের কিল্লা যথায় আছে অবরোধ করি
বীর মুসলিম সেনাদল তব বহু দিন মাস ধরি।
দুর্গের দ্বার খুলিবে তাহারা বলেছে শত্রু শেষে-
উমর যদি গো সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করে এসে!
হায় রে, আধেক ধরার মালিক আমির-উল-মুমেনিন
শুনে সে খবর একাকী উষ্ট্রে চলেছে বিরামহীন
সাহারা পারায়ে! ঝুলিতে দু খানা শুকনো ‘খবুজ’ রুটি
একটি মশকে একটুকু পানি খোর্মা দু তিন মুঠি।
প্রহরীবিহীন সম্রাট চলে একা পথে উটে চড়ি
চলেছে একটি মাত্র ভৃত্য উষ্ট্রের রশি ধরি!
মরুর সূর্য ঊর্ধ্ব আকাশে আগুন বৃষ্টি করে,
সে আগুন-তাতে খই সম ফোটে বালুকা মরুর পরে।
কিছুদূর যেতে উঠ হতে নামি কহিলে ভৃত্যে, ‘ভাই
পেরেশান বড় হয়েছ চলিয়া! এইবার আমি যাই
উষ্ট্রের রশি ধরিয়া অগ্রে, তুমি উঠে বস উটে,
তপ্ত বালুতে চলি যে চরণে রক্ত উঠেছে ফুটে।’
…ভৃত্য দস্ত চুমি
কাঁদিয়া কহিল, ‘উমর! কেমনে এ আদেশ কর তুমি?
উষ্ট্রের পিঠে আরাম করিয়া গোলাম রহিবে বসি
আর হেঁটে যাবে খলিফা উমর ধরি সে উটের রশি?’
খলিফা হাসিয়া বলে,
‘তুমি জিতে গিয়ে বড় হতে চাও, ভাই রে, এমনি ছলে।
রোজ-কিয়ামতে আল্লাহ যে দিন কহিবে, ‘উমর! ওরে
করেনি খলিফা, মুসলিম-জাঁহা তোর সুখ তরে তোরে।’
কি দিব জওয়াব, কি করিয়া মুখ দেখাব রসুলে ভাই।
আমি তোমাদের প্রতিনিধি শুধু, মোর অধিকার নাই।
আরাম সুখের, -মানুষ হইয়া নিতে মানুষের সেবা।
ইসলাম বলে, সকলে সমান, কে বড় ক্ষুদ্র কেবা।
ভৃত্য চড়িল উটের পৃষ্ঠে উমর ধরিল রশি,
মানুষে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া ধুলায় নামিল শশী।
জানি না, সেদিন আকাশে পুষ্প বৃষ্টি হইল কিনা,
কি গান গাহিল মানুষে সেদিন বন্দী’ বিশ্ববীণা।
জানি না, সেদিন ফেরেশতা তব করেছে কি না স্তব-
অনাগত কাল গেয়েছিল শুধু, ‘জয় জয় হে মানব।’
* * * * * * * * * *
তুমি নির্ভীক, এক খোদা ছাড়া করনি ক’ কারে ভয়,
সত্যব্রত তোমায় তাইতে সবে উদ্ধত কয়।
মানুষ হইয়া মানুষের পূজা মানুষেরি অপমান,
তাই মহাবীর খালদেরে তুমি পাঠাইলে ফরমান,
সিপাহ-সালারে ইঙ্গিতে তব করিলে মামুলি সেনা,
বিশ্ব-বিজয়ী বীরেরে শাসিতে এতটুকু টলিলে না।
* * * * * * * * * *
মানব-প্রেমিক! আজিকে তোমারে স্মরি,
মনে পড়ে তব মহত্ত্ব-কথা – সেদিন সে বিভাবরী
নগর-ভ্রমণে বাহিরিয়া তুমি দেখিতে পাইলে দূরে
মায়েরে ঘিরিয়া ক্ষুদাতুর দুটি শিশু সকরুণ সুরে
কাঁদিতেছে আর দুখিনী মাতা ছেলেরে ভুলাতে হায়,
উনানে শূন্য হাঁড়ি চড়াইয়া কাঁদিয়া অকুলে চায়।
শুনিয়া সকল – কাঁদিতে কাঁদিতে ছুটে গেলে মদিনাতে
বায়তুল-মাল হইতে লইয়া ঘৃত আটা নিজ হাতে,
বলিলে, ‘এসব চাপাইয়া দাও আমার পিঠের ‘পরে,
আমি লয়ে যাব বহিয়া এ-সব দুখিনী মায়ের ঘরে’।
কত লোক আসি আপনি চাহিল বহিতে তোমার বোঝা,
বলিলে, ‘বন্ধু, আমার এ ভার আমিই বহিব সোজা!
রোজ-কিয়ামতে কে বহিবে বল আমার পাপের ভার?
মম অপরাধে ক্ষুধায় শিশুরা কাঁদিয়াছে, আজি তার
প্রায়শ্চিত্ত করিব আপনি’ – চলিলে নিশীথ রাতে
পৃষ্ঠে বহিয়া খাদ্যের বোঝা দুখিনীর আঙিনাতে!
এত যে কোমল প্রাণ,
করুণার বশে তবু গো ন্যায়ের করনি ক’ অপমান!
মদ্যপানের অপরাধে প্রিয় পুত্রেরে নিজ করে
মেরেছ দোররা, মরেছে পুত্রে তোমার চোখের পরে!
ক্ষমা চাহিয়াছে পুত্র, বলেছ পাষাণে বক্ষ বাঁধি-
‘অপরাধ করে তোরি মতো স্বরে কাঁদিয়াছে অপরাধী।’
আবু শাহমার গোরে
কাঁদিতে যাইয়া ফিরিয়া আসি গো তোমারে সালাম করে।
খাস দরবার ভরিয়া গিয়াছে হাজার দেশের লোকে,
‘কোথায় খলিফা’ কেবলি প্রশ্ন ভাসে উৎসুক চোখে,
একটি মাত্র পিরান কাচিয়া শুকায়নি তাহা বলে,
রৌদ্রে ধরিয়া বসিয়া আছে গো খলিফা আঙিনা-তলে।
হে খলিফাতুল-মুসলেমিন! হে চীরধারী সম্রাট!
অপমান তব করিব না আজ করিয়া নান্দী পাঠ,
মানুষেরে তুমি বলেছ বন্ধু, বলিয়াছ ভাই, তাই
তোমারে এমন চোখের পানিতে স্মরি গো সর্বদাই।
(সংক্ষেপিত)
এক আল্লাহ জিন্দাবাদ
- কাজী নজরুল ইসলাম
উহারা প্রচার করুক হিংসা বিদ্বেষ আর নিন্দাবাদ;
আমরা বলিব সাম্য শান্তি এক আল্লাহ জিন্দাবাদ।
উহারা চাহুক সংকীর্ণতা, পায়রার খোপ, ডোবার ক্লেদ,
আমরা চাহিব উদার আকাশ, নিত্য আলোক, প্রেম অভেদ।
উহারা চাহুক দাসের জীবন, আমরা শহীদি দরজা চাই;
নিত্য মৃত্যু-ভীত ওরা, মোরা মৃত্যু কোথায় খুঁজে বেড়াই!
ওরা মরিবেনা, যুদ্ব বাধিঁলে ওরা লুকাইবে কচুবনে,
দন্তনখরহীন ওরা তবু কোলাহল করে অঙ্গনে।
ওরা নির্জীব; জিব নাড়ে তবু শুধূ স্বার্থ ও লোভবশে,
ওরা জিন, প্রেত, যজ্ঞ, উহারা লালসার পাঁকে মুখ ঘষে।
মোরা বাংলার নব যৌবন,মৃত্যুর সাথে সন্তরী,
উহাদের ভাবি মাছি পিপীলিকা, মারি না ক তাই দয়া করি।
মানুষের অনাগত কল্যাণে উহারা চির অবিশ্বাসী,
অবিশ্বাসীরাই শয়তানী-চেলা ভ্রান্ত-দ্রষ্টা ভুল-ভাষী।
ওরা বলে, হবে নাস্তিক সব মানুষ, করিবে হানাহানি।
মোরা বলি, হবে আস্তিক, হবে আল্লাহ মানুষে জানাজানি।
উহারা চাহুক অশান্তি; মোরা চাহিব ক্ষমাও প্রেম তাহার,
ভূতেরা চাহুক গোর ও শ্মশান, আমরা চাহিব গুলবাহার!
আজি পশ্চিম পৃথিবীতে তাঁর ভীষণ শাস্তি হেরি মানব
ফিরিবে ভোগের পথ ভয়ে, চাহিবে শান্তি কাম্য সব।
হুতুম প্যাচারা কহিছে কোটরে, হইবেনা আর সূর্যোদয়,
কাকে আর তাকে ঠোকরাইবেনা, হোক তার নখ চষ্ণু ক্ষয়।
বিশ্বাসী কভু বলেনা এ কথা, তারা আলো চায়, চাহে জ্যোতি;
তারা চাহে না ক এই উৎপীড়ন এই অশান্তি দূর্গতি।
তারা বলে, যদি প্রার্থনা মোরা করি তাঁর কাছে এক সাথে,
নিত্য ঈদের আনন্দ তিনি দিবেন ধুলির দুনিয়াতে।
সাত আসমান হতে তারা সাত-রঙা রামধনু আনিতে চায়,
আল্লা নিত্য মহাদানী প্রভূ, যে যাহা চায়, সে তাহা পায়।
যারা অশান্তি দুর্গতি চাহে, তারা তাই পাবে, দেখো রে ভাই,
উহারা চলুক উহাদের পথে, আমাদের পথে আমরা যাই।
ওরা চাহে রাক্ষসের রাজ্য, মেরা আল্লার রাজ্য চাই,
দ্বন্দ্ব-বিহীন আনন্দ-লীলা এই পৃথিবীতে হবে সদাই।
মোদের অভাব রবে না কিছুই, নিত্যপূর্ণ প্রভূ মোদের,
শকুন শিবার মত কাড়াকাড়ি করে শবে লয়ে– শখ ওদের!
আল্লা রক্ষা করুন মোদেরে, ও পথে যেন না যাই কভূ,
নিত্য পরম-সুন্দর এক আল্লাহ্ আমাদের প্রভূ।
পৃথিবীতে যত মন্দ আছে তা ভালো হোক, ভালো হোক ভালো,
এই বিদ্বেষ-আঁধার দুনিয়া তাঁর প্রেমে আলো হোক, আলো।
সব মালিন্য দূর হয়ে যাক সব মানুষের মন হতে,
তাঁহার আলোক প্রতিভাত হোক এই ঘরে ঘরে পথে পথে।
দাঙ্গা বাঁধায়ে লুট করে যারা, তার লোভী, তারা গুন্ডাদল
তারা দেখিবেনা আল্লাহর পথ চিরনির্ভয় সুনির্মল।
ওরা নিশিদিন মন্দ চায়, ওরা নিশিদিন দ্বন্দ চায়,
ভূতেরা শ্রীহীন ছন্দ চায়, গলিত শবের গন্ধ চায়!
তাড়াবে এদের দেশ হতে মেরে আল্লার অনাগত সেনা,
এরাই বৈশ্য, ফসল শৈস্য লুটে খায়, এরা চির চেনা।
ওরা মাকড়সা, ওদের ঘরের ঘেরোয়াতে কভু যেয়ো না কেউ,
পর ঘরে থাকে জাল পেতে, ওরা দেখেনি প্রাণের সাগর ঢেউ।
বিশ্বাস করো এক আল্লাতে প্রতি নিঃশ্বাসে দিনে রাতে,
হবে দুলদুল – আসওয়ার পাবে আল্লার তলোয়ার হাতে।
আলস্য আর জড়তায় যারা ঘুমাইতে চাহে রাত্রিদিন,
তাহারা চাহে না চাঁদ ও সূর্য্য, তারা জড় জীব গ্লানি-মলিন।
নিত্য সজীব যৌবন যার, এস এস সেই নৌ-জোয়ান
সর্ব-ক্লৈব্য করিয়াছে দূর তোমাদেরই চির আত্বদান!
ওরা কাদা ছুড়ে বাঁধা দেবে ভাবে – ওদের অস্ত্র নিন্দাবাদ,
মোরা ফুল ছড়ে মারিব ওদের, বলিব – “এক আল্লাহ জিন্দাবাদ”।
মুনাজাত
-কাজী নজরুল ইসলামআমারে সকল ক্ষুদ্রতা হতে
বাঁচাও প্রভু উদার।
হে প্রভু! শেখাও – নীচতার চেয়ে
নীচ পাপ নাহি আর।
যদি শতেক জন্ম পাপে হই পাপী,
যুগ-যুগান্ত নরকেও যাপি,
জানি জানি প্রভু, তারও আছে ক্ষমা-
ক্ষমা নাহি নীচতার।।
ক্ষুদ্র করো না হে প্রভু আমার
হৃদয়ের পরিসর,
যেন সম ঠাঁই পায়
শত্রু-মিত্র-পর।
নিন্দা না করি ঈর্ষায় কারো
অন্যের সুখে সুখ পাই আরো,
কাঁদি তারি তরে অশেষ দুঃখী
ক্ষুদ্র আত্মা তার।।
বার বার ফিরে আসে
শামসুর
রহমান
বার
বার ফিরে আসে, রক্তাপ্লুত শার্ট
ময়দানে
ফিরে আসে, ব্যাপক নিসর্গে ফিরে আসে,
ফিরে
আসে থমথমে শহরের প্রকান্ড চোয়ালে।
হাওয়ায়
হাওয়ায় ওড়ে, ঘোরে হাতে হাতে,
মিছিলে
পতাকা হয় বারবার রক্তাপ্লুত শার্ট।
বিষম
দামাল দিনগুলি ফিরে আসে বারবার,
বারবার
কল্পোলিত আমাদের শহর ও গ্রাম।
আবার
আসবো ফিরে বলে সজীব কিশোর
শার্টের
আস্তিন দ্রুত গোটাতে গোটাতে
শ্লোগানের
নিভাঁজ উল্লাসে
বারবার
মিশে যায় নতুন মিছিলে, ফেরে না যে আর।
একটি
মাযের চোখ থেকে
করুণ
প্লাবন মুছে যেতে না যেতেই
আরেক
মাযের চোখ শ্রাবণের অঝোর আঁকাশ হয়ে যায়।
একটি
বধুর
সংসার
উজাড় করা হাহাকার থামতে না থামতেই, হায়,
আরেক
বধূর বুক খাঁ খাঁ গোরস্থান হয়ে যায়,
একটি
পিতার হাত থেকে কবরের কাঁচা মাটি
ঝরে
পড়তে না পড়তেই
আরেক
পিতার বুক শূণ্য করা গুলিবিদ্ধ সন্তানের লাশ
নেমে
যায় নীরন্ধ্র কবরে।
বারবার
ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট,
ময়দানে
ফিরে আসে, ব্যাপক নিসর্গে ফিরে আসে,
ফিরে
আসে থমথমে শহরের প্রকান্ড চোয়ালে।
উনিশ
শো উনসত্তরের
তরুণ
চীৎকৃত রৌদ্রে যে ছেলেটা খেলতো রাস্তায়,
বানাতো
ধুলোর দুর্গ, খেতো লুটোপুটি নর্দমার ধারে
বিষ্ময়ে
দেখতো চেয়ে ট্রাক, জীপ,
রাইফেল,
টিউনিক, বেয়োনেট, বুট, হেলমেট,
এখন
সে টলমল পদভরে শরীক মিছিলে।
লাজনম্র
যে মেয়েটি থাকতো আড়ালে সর্বক্ষণ,
যে
ছিল অসূর্যম্পশ্যা, এখন সে ঝলসায় মিছিলে মিছিলে।
তাদের
পায়ের নিচে করে জ্বল জ্বল নীল নকশা নব্য সভ্যতার।
বারবার
ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট,
ময়দানে
ফিরে আসে, ব্যাপক নিসর্গে ফিরে আসে,
ফিরে
আসে থমথমে শহরের প্রকান্ড চোয়ালে।
হতাশাকে
লাথি মেরে, ভয়কে বেদম লাঠি পেটা করে
সবখানের
শ্লোগানের ফুলকি ছড়াই।
বারবার
আমাদের হাত হয় উদ্দাম নিশান,
বারবার
ড়ৃ্ষুব্ধ পদ্মা হই আমরা সবাই।
আমাকেই
হ্ত্যা করে ওরা, বায়ান্নোর রৌদ্রময় পথে,
আমাকেই
হত্যা করে ওরা,
উনসত্তরের
বিদ্রোহী প্রহরে,
একাত্তরে
পুনরায় হত্যা করে ওরা আমাকেই
আমাকেই
হত্যা করে ওরা
পথের
কিনারে
এভেন্যুর
মোড়ে
মিছিলে,
সভায়-
আমাকেই
হত্যা করে, ওরা হত্যা করে বারবার।
তবে
কি আমার বাংলাদেশ শুধু এক সুবিশাল শহীদ মিনার হয়ে যাবে?
তালেব মাস্টার
(মানিক
বন্দ্যোপাধ্যায়কে)
আশরাফ সিদ্দিকী
[জন্ম:
১৯০১, মৃত্যু: ১৯৩৯]
তালসোনাপুরের
তালেব মাস্টার আমিঃ
আজ থেকে
আরম্ভ করে চল্লিশ বছর দিবসযামী
যদিও করছি
লেন নয় শিক্ষার দেন
(মাফ করবেন!
নাম শুনেই চিনবেন)
এমন কথা
কেমন করি বলি!
তবুও যখন
ঝাড়তে বসি স্মৃতির থলি
মনে পড়ে
অনেক অনেক কচি মুখ, চপল চোখঃ
শুনুনঃ
গর্বের সাথেই বলিঃ
তাদের ভেতর
অনেকেই এখন বিখ্যাত লোক!
গ্রাম্য
পাঠশালার দরিদ্র তালেব মাস্টারকে
না চিনতে
পারেন! কিন্তু তাদেরকে
নাম শুনেই
চিনবেন!
(মুনাজাত
করি!খোদা তাদের আরও বড় করেন।)
অনেক বয়স
হয়ে গিয়েছে আমার
পিঠ বেঁকে
গিয়েছে আর
চোখেও ভাল
দেখি না তেমন
তাই ভাবছিঃ
সময় থাকতে থাকতে এখন
আত্মকাহিনীটা
লিখে যাবো আমার!
রবিবাবু
থেকে আরম্ভ করে আজকের তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
আর কত সাহেব,
চট্টোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, রায়....
কত কাহিনীই
আপনারা লিখে গেলেন।
কিন্তু
মানিকবাবু!অগনি কী এমন একটি কাহীনী শুনেছেনঃ
কোথাও রোমাঞ্চ
নেই? খাঁটি করুন বাস্তবতা-
এবং এই
বাংলাদেশেরই কথা!
নমষ্কার।
আমিই সেই
ভালসোনাপুরের তালেব মাস্টার!
আরম্ভটা
শুধুই সাধারণ। কারণ
রক্তস্নানে
শুভ্র হয়ে সত্তর বছর পুর্বে যখন
প্রথম আলো
দেখলাম, হাসলাম এবং বাড়লাম
তখন থেকেই ট্রাজিডি চলছে অবিরাম!
লেখাপড়ায়
যদিও খুব ভাল ছাত্র ছিলাম
অষ্টম শ্রেণীতে
উঠেই বন্ধ করে দিতে হল কারণ
পিতামাতার
সংসারে নিদারুণ অনটন!
জমিদার
সাহেবের কুপায় চাকুরি জুটে গেল একখানা
ডজন খানেক
ছেলেমেয়ে পড়ানো; মাসিক বেতন
তিন টাকা
আট আনা
(তাদের
ভেতর একজন এখন ব্যারিষ্টার!
জানি না
তালেব মাষ্টারকে মনে আছে কিনা তার!)
পাঠশালা
খুলেছি তারপর
দূদীর্ঘ
দিন ধরে বহু ঝঞ্ঝা ঝড়
বড়ে গেছে।
ভুলেছি
অক্লান্তভাবেই
জ্ঞানের প্রদীপ জ্বেলেছি।
পানির মত
বছর কেটে গেল
কত ছাত্র
গেল, এল-
প্রমোশন
পেল।
কিন্তু
দশ টাকার বেশি প্রমোশন হয়নি আমার!
কপালে করাঘাত
করেছিলাম জীবনে প্রথম সেবার
যখন টাকার
অভাবে একটি মাত্র ছেলের পড়া বন্ধ হল!
আক্রার
বাজার। চাল-নুনেই কাবার!
কীই বা
করার ছিল আমার!
No comments:
Post a Comment